গাজা যুদ্ধের ৫৯৯তম দিনে ফিলিস্তিন সংকট নতুন মাত্রা পেল। গতকাল বৃহস্পতিবার অধিকৃত পশ্চিম তীরে একযোগে নতুন করে ২২টি বসতি স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল, যা সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে দেশটির সবচেয়ে বড় উপনিবেশ সম্প্রসারণের পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ঘোষণা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন গাজার মানবিক পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে, এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনের নিরাপত্তা ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বৃহস্পতিবার এই ঘোষণা দিয়ে জানান, পশ্চিম তীরের ‘রুট ৪৪৩’ সড়ক ঘিরেই গড়ে তোলা হবে নতুন এসব বসতি, যা মোদিইন হয়ে জেরুজালেম ও তেল আবিবকে সংযুক্ত করে। একই সঙ্গে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের পূর্বে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিগুলোকে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। বসতি স্থাপনকে ‘কৌশলগত প্রয়োজন’ বলে অভিহিত করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ দাবি করেছেন, এর মাধ্যমে “ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করা সম্ভব হবে,” যা ইসরায়েলের জন্য হুমকি হতে পারে।
এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও হামাস। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র একে “বিপজ্জনক উসকানি” এবং “অবৈধ দখলদারিত্বকে বৈধতা দেওয়ার চক্রান্ত” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর অভিযোগ, উগ্রবাদী ইসরায়েলি সরকার সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার নতুন চক্রে ফিলিস্তিন অঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে গাজার পরিস্থিতিও ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। গতকালও গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর আগের দুই দিনেও এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ঘিরে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত এই সংস্থা ত্রাণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং নিরপেক্ষ মানবিক সহায়তার নীতিকে লঙ্ঘন করছে।
মধ্য গাজার নেটজারিম করিডর, বুরেইজ শরণার্থী শিবির ও জাবালিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৫ জন ফিলিস্তিনি। শিশু ও নারীদের সংখ্যা সেখানে উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানায়, একটি কিন্ডারগার্টেন এবং আবাসিক ভবনে বিমান হামলা চালিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
ত্রাণের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গত বুধবার মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরের একটি খাদ্যগুদামে ঢুকে পড়ে শত শত মানুষ। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় অন্তত দুইজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। ডব্লিউএফপি এক বিবৃতিতে জানায়, দীর্ঘ অবরোধের ফলে গাজার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এসব এলাকায় বসতি স্থাপন অবৈধ হলেও, ইসরায়েল গত কয়েক দশকে একের পর এক বসতি গড়ে তুলেছে। বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ১৬০টি বসতিতে বসবাস করছেন প্রায় সাত লাখ ইসরায়েলি নাগরিক।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই বসতিগুলোর স্বীকৃতি দেয় না। তবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতি বারবার এই উপনিবেশ সম্প্রসারণকেই সামনে এনেছে। পশ্চিম তীরে নতুন করে ২২টি বসতির ঘোষণা সেই চেষ্টাকেই আরও আক্রমণাত্মক রূপ দিল। এই ঘোষণা শুধু যে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে গভীরতর করল তা নয়, একইসঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও আরও দূরে ঠেলে দিল।
Leave a comment