বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পলাশ সাহার মৃত্যুর আগে লেখা সুইসাইড নোট ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন। তার মৃত্যুর পেছনে কে বা কারা দায়ী—তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ফরেনসিক হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের আলোকে উঠে এসেছে চমকপ্রদ কিছু মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিত, যা পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আবেগগত অস্থিরতাকে সামনে এনে দিয়েছে।
হস্তাক্ষর ও মানসিক বিশ্লেষণভিত্তিক এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফরেনসিক সাইকোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস-এর পরিচালক ও হস্তাক্ষর বিশ্লেষক ড. মো. মিরাজ হোসেন। তার মতে, “পলাশ স্যারের নোট দেখে তার মাকে বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে আমার। উনার সম্পর্কে ভালো করে তদন্ত করা দরকার।”
হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—মার্জিন, শব্দের গঠন, লাইনের আকৃতি, অক্ষরের আকার এবং লেখার স্ল্যান্ট। এই সব দিক থেকে পলাশ সাহার লেখা সুইসাইড নোটে একাধিক অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে, যা লেখকের মানসিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বপূর্ণ আবেগের প্রতিফলন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, লেখার মার্জিন ছিল অনিয়মিত। কোথাও শব্দগুলো কাগজের অনেক দূরে, আবার কোথাও মাঝখানে চলে এসেছে। এটি ইঙ্গিত করে লেখকের মধ্যে স্বাধীনতার ইচ্ছা থাকলেও পরবর্তীতে নিরাপত্তার অভাব ও অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন তিনি। তার লেখার শব্দগুলো বড় আকারের, যা ‘অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়র’ এর লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়।
লাইনের গঠন ছিল ‘ওয়েভি’, বিশেষ করে নিচে-উপরে ওঠানামা করে এমন লাইনগুলোর উপস্থিতি চরম আবেগগত অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। নোটের কিছু অংশে Arcade Handwriting দেখা গেছে—যেখানে লেখার ধরণ উপরের দিকে বাঁকানো—এটি লেখকের নিজেকে আবেগগতভাবে ঢেকে রাখার প্রবণতা এবং অন্যদের প্রতি কেয়ারের প্রকাশ।
বিশ্লেষকের মতে, “নোটের শুরুতেই লেখা—‘আমার মৃত্যুর জন্য মা এবং বউ কেউ দায়ী না’। কিন্তু লেখায় ‘মা’ শব্দটি নিচের দিকে ও জোরে লেখা, যা নেতিবাচক আবেগ প্রকাশ করে। বিপরীতে, ‘বউ’ শব্দটি তুলনামূলকভাবে হালকা ও ওপরে লেখা, যা তুলনামূলক ইতিবাচক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।” এছাড়াও একটি লাইনে লেখা ছিল—“কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না”—যেখানে ‘ভালো রাখতে’ অংশটি উপরের দিকে এবং ‘পারলাম না’ অংশটি নিচের দিকে, যা হতাশা ও ব্যর্থতার প্রকাশ বলে বিবেচিত।
অক্ষরের ধারালোতা থেকে বোঝা যায়, লেখকের মাঝে খোঁচা মেরে কথা বলার প্রবণতা থাকতে পারে। কিছু অক্ষরের আকৃতি ও অস্বাভাবিক টান ছিল অতিরিক্ত প্রত্যাশার প্রকাশ, যা বাস্তবে হতাশার জন্ম দিয়েছে। কিছু অক্ষর যেমন ‘র’ বামদিকে হেলে ছিল, যা অতীত নিয়ে ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। লেখার কোনো স্থিতিশীলতা নেই—কখনো শব্দ বড়, কখনো ছোট—যা আবেগের অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আত্মহত্যামূলক নোটে সাধারণত কিছু মানসিক সংকট প্রতিফলিত হয়—যেমন অতিরিক্ত চাপ দিয়ে লেখা, হঠাৎ করে শব্দের বড় হয়ে যাওয়া, লাইনের নিচের দিকে নামা, কাটাকাটি থাকা, অথবা একাকিত্ব থেকে শব্দ ও লাইনের মধ্যে বড় দূরত্ব রাখা। পলাশ সাহার নোটেও এসব লক্ষণ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান।
তবে মো. মিরাজ হোসেন এককভাবে কাউকে দায়ী না করলেও তার মতে, “লেখায় যেভাবে আবেগ প্রবাহিত হয়েছে, তাতে মায়ের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ককে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে তদন্ত করা দরকার।”
বাংলাদেশে এখনো বাংলা হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ একটি গবেষণাধর্মী ক্ষেত্র হলেও, এই ধরনের ফরেনসিক ব্যাখ্যা তদন্তকারীদের জন্য দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। পলাশ সাহার মৃত্যুতে তার পরিবার, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের মধ্যে শোক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এখন সময়ের দাবি—এই মৃত্যু কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা হিসেবেই না থেকে, এর গভীরে থাকা সত্যগুলো খুঁজে বের করে প্রকৃত দায়ীদের জবাবদিহির মুখোমুখি করা।
Leave a comment