দুটি ভিন্ন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা, ১১এ আসনে থাকা দুই যাত্রীর অলৌকিক বেঁচে ফেরা

একটি সাধারণ আসন নম্বর—১১এ। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন দেশে এবং ভিন্ন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় এই আসনেই বসা দুই যাত্রী জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। সময়ের ব্যবধান প্রায় তিন দশক, কিন্তু মিল যেন অবিশ্বাস্যভাবে অভিন্ন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এয়ার ইন্ডিয়া এআই-১৭১ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ছিলেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিষ্ণু কুমার রমেশ। ৪০ বছর বয়সী বিষ্ণু কুমার লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে। উড্ডয়নের কিছু সময় পরেই বিমানটি সোজা বিধ্বস্ত হয় শহরের একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস ভবনে। বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটি ছিল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের, যেখানে যাত্রী ও ক্রুসহ মোট ২৪২ জন আরোহী ছিলেন। সেই ভয়াল দুর্ঘটনায় সবাই প্রাণ হারালেও বিষ্ণু কুমার অলৌকিকভাবে বেঁচে যান—আর তিনি বসেছিলেন ১১এ আসনে।

এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই চোখ কপালে ওঠে থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক জেমস রুয়াংসাক লইচুসাকের। কারণ, ঠিক একই আসন ১১এ-তেই বসা অবস্থায় তিনি নিজে ১৯৯৮ সালে থাইল্যান্ডে এক ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ছিলেন থাই এয়ারওয়েজের টিজি২৬১ ফ্লাইটে। ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সুরাট থানি শহরে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটি মাঝআকাশে গতি হারিয়ে ভেঙে পড়ে। উড়োজাহাজটিতে তখন ১৪৬ জন যাত্রী ছিলেন, যাদের মধ্যে ১০১ জন প্রাণ হারান। জেমসসহ হাতে গোনা কয়েকজন জীবিত থাকেন—জেমস ছিলেন ১১এ আসনে।

ভারতে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার খবরে জেমস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “ভারতে যে একমাত্র ব্যক্তি বেঁচে গেছেন, তিনিও বসেছিলেন ১১এ আসনে। আমি স্তম্ভিত।” তাঁর এই মন্তব্য ভাইরাল হয়ে পড়ে এবং বহু সংবাদমাধ্যম ১১এ আসনের এই অলৌকিক মিলকে সামনে এনে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

যদিও দুটি উড়োজাহাজ আলাদা মডেলের এবং আলাদা কোম্পানির, তথাপি যাত্রী আসনের কাঠামোগত বিন্যাসে কিছু ভিন্নতা থাকলেও আসন নম্বরের এমন মিল অনেককেই কাকতালীয় বলে মনে হয়েছে। থাই এয়ারওয়েজ দুর্ঘটনার সময় ব্যবহৃত উড়োজাহাজটি ছিল এয়ারবাস এ৩১০, আর এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজটি ছিল ড্রিমলাইনার বোয়িং ৭৮৭-৮। ফলে ১১এ আসন দুই বিমানে একই জায়গায় না-ও থাকতে পারে, কিন্তু দুই জনের অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া অনেকেই রহস্যজনক বলে মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এই ঘটনাকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা গেলে কাকতালীয় হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, প্রতি ফ্লাইটে নির্দিষ্ট কিছু আসনে যাত্রীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি হতে পারে, যেমন ডানা সংলগ্ন বা নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা আসন। কিন্তু ১১এ সংখ্যাটি এত বছর পর আবার এমন একটি ঘটনায় উঠে আসা নিঃসন্দেহে মানবিক কৌতূহলের বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেঁচে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিষ্ণু কুমার বলেন, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমি জীবিত। ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তোলার পর যখন শুনলাম আমি ১১এ-তে ছিলাম, আমি কাঁপতে শুরু করি। পরে যখন দেখলাম, অনেক বছর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল আর সেই যাত্রীও ১১এ-তে ছিলেন—তখন বুঝলাম জীবন মাঝে মাঝে কীভাবে ব্যাখ্যাতীতভাবে রহস্যময় হয়ে ওঠে।”

এই মুহূর্তে বিষ্ণু কুমার ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর শরীরে মারাত্মক আঘাত থাকলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। অন্যদিকে, থাই অভিনেতা জেমস রুয়াংসাক আজও মনে করেন, ১১এ নম্বর তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি বেঁচে গিয়েছিলাম সেই দুর্ঘটনায়, এরপরের জীবন ছিল নতুন করে পাওয়া। আমি বিশ্বাস করি, এই নম্বরের সঙ্গে আমার আত্মিক এক সম্পর্ক আছে।”

জীবন-মৃত্যুর এমন নাটকীয় টানাপোড়েনের মধ্যে দুটি দুর্ঘটনা এক সুতায় গাঁথা হয়ে যেন একটি বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করল। ১১এ এখন শুধু একটি আসন নয়, হয়ে উঠেছে দুইজন বেঁচে যাওয়ার প্রতীক। নিয়তির এই খেলা কতটা কাকতাল, আর কতটা রহস্যে ঘেরা—তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক চলবেই, তবে মানুষের বিস্ময় এখানে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।