তেহরান যেন এক বিস্ফোরণের আগের মুহূর্তে আটকে পড়া শহর—নীরবতা, আতঙ্ক আর বিভীষিকায় ঘেরা এক অচেনা রাজধানী। এখানে আজ আর কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমায় না। কেউ জানে না আগামী সকালটা আসবে কি না। জানে না, আর কখনো প্রিয় ঘরে ফিরতে পারবে কি না। ইসরায়েলি হামলার আতঙ্কে রাজধানী তেহরান ছেড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। গন্তব্য কারও জানা নেই। তাদের মুখে আতঙ্ক, চোখে অশ্রু, হাতে ব্যাগ, মনে শুধুই এক প্রশ্ন—‘কোথায় যাব আমি?’
বিগত এক সপ্তাহে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাজধানী তেহরান কার্যত জনশূন্য হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ১৫ জুন থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের একতরফা বিমান হামলার পর পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে যায়। শহরের প্রতিটি সড়কে দেখা গেছে হাজার হাজার মানুষ—কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে, কেউবা শিশু কোলে করে ছুটে চলেছেন শহর ছাড়ার অজানা যাত্রায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পেট্রলপাম্পে দীর্ঘ লাইন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনের সারি, কারও চোখে অনিশ্চয়তার কুয়াশা।
তেহরানের এই বাস্তবতা যেন হুবহু মিল খুঁজে পায় কবি জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’ কবিতার দুলালী বা প্রিয়বালার সঙ্গে। তাঁদের মতোই এই মানুষগুলোরও জানা নেই গন্তব্যের নাম। শুধু প্রাণের টানে, বাঁচার চেষ্টায় তাঁরা পথে নেমেছেন। শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে কেউ কেউ নিজেদের ঘরের ছবি তুলে নিচ্ছেন, ক্যাপশন দিচ্ছেন—‘দ্য লাস্ট ফটো অব হোম’। সোফায় রাখা বালিশ, টেবিলের ওপর ফুলের টব, আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাগ—সবকিছুর ছবি তুলে তাঁরা বিদায় জানাচ্ছেন প্রিয় আশ্রয়কে।
বিবিসি ও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই বিদায়ের করুণ বিবরণ। এক নারী লিখেছেন, “গাছগুলোকে পানি দিয়ে এলাম, প্রিয়জনদের দেওয়া উপহার গুছিয়ে নিলাম, তবু বুক ফেটে যাচ্ছে। ফেরা হবে কি না জানি না।” এক তরুণ তাঁর কম্পিউটার আর হেডফোনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, “যা কিছু ভালোবেসে অর্জন করেছি, বিদায় জানালাম—আশা করি, আবার ফিরে পাবো।”
এদের মধ্যে রয়েছে ২২ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র ফরহাদ, যিনি তেহরান ছেড়েছেন ইসরায়েলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে। ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে গাড়ির জানালায় তাকিয়ে তিনি দেখেছেন পুড়তে থাকা ভবন, আকাশে ধোঁয়া আর রাস্তা জুড়ে ছুটে চলা নির্বাক জনস্রোত। মিনা নামের ২৪ বছর বয়সী আরেক চাকরিজীবী ১০ ঘণ্টার যাত্রায় পৌঁছেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে, কিন্তু আতঙ্ক এখনো কাটেনি। “যানজটে বসে সারাক্ষণ ভাবছিলাম, এখন যদি রাস্তায় বোমা পড়ে? আমাদের চারপাশে যদি গোপন অস্ত্রাগার থাকে?”—এই ভয়ই তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
সবাই কি তবে যেতে পারছে? না। তেহরান এখন তিন ধরনের মানুষের শহর—যারা যাওয়ার জায়গা খুঁজে পেয়েছে, যারা খরচ মেটাতে পারেনি, আর যারা সরকারি দায়িত্বে বাঁধা পড়ে আছে। এমনই একজন ৪০ বছর বয়সী নারী জানান, “আমার সন্তানদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য নেই। যদি শহর ধ্বংসও হয়, আমরা এখানেই থাকব। কারণ, আরেকবার শুরু করার শক্তি নেই।”
এদিকে শহরের অর্ধেক মানুষ শহর ছাড়লেও কারাগারে বন্দীদের কোনো উপায় নেই। মানবাধিকারকর্মী রেজা খানদান বর্তমানে তেহরানের berüchtigte এভিন কারাগারে। তাঁর মেয়ে মেহরাভেহ বিস্মিত হয়ে বলেন, “আমার বাবা কীভাবে তেহরান ছাড়বেন? তাঁকে তো বলা হচ্ছে শহর ছাড়ুন। মানে কী?”
শহরের অধিকাংশ অঞ্চল এখন কার্যত লকডাউন পরিস্থিতিতে। চলছে কেবল ব্যাংক আর সিটি করপোরেশনের আংশিক কার্যক্রম। বাজারে খাদ্য সংকট, জ্বালানির মাপকাঠি নির্ধারিত হয়েছে—প্রতিদিন একজনকে ১০ লিটারের বেশি জ্বালানি দেওয়া হচ্ছে না। এসব কারণে প্রতিটি পেট্রলপাম্পে তৈরি হয়েছে দীর্ঘ লাইন। শহরজুড়ে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর অসহায়তা ঘিরে ফেলেছে জনজীবনকে।
অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন ইরান-তুরস্ক সীমান্তের দিকে। উত্তর-পূর্ব তুরস্কের রাজি-কাপিকোয় সীমান্ত দিয়ে বহু ইরানি আশ্রয় চাচ্ছেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, নতুন দেশ তাঁদের গ্রহণ করবে কি না। অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিটি পা ফেলছেন আতঙ্ক আর আশা একসঙ্গে বয়ে নিয়ে।
ইসরায়েলি বিমান হামলার ভয়াবহতায় বহু তেহরানবাসী এখন উদ্বাস্তু। কেউ নিজের শহরের ধ্বংস দেখতে দেখতে ছেড়ে যাচ্ছেন, কেউ কেবল বাঁচার জন্য। তবে শহর ছেড়েও তাঁরা তেহরানকে ভুলতে পারছেন না। মিনা বলেন, “আমি কিছুই আনিনি, শুধু বাঁচার জন্য দরকারি কিছু জিনিস। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে তেহরানেই। আমি শুধু আশা নিয়ে এসেছি।”
প্রিয়বালার মতোই তেহরানবাসীর নাম এখন লেখা হবে সীমান্তের শরণার্থী তালিকায়, বা ইমিগ্রেশন অফিসের খাতায়। হয়তো কেউ টবে সাজানো গাছের পাতায় রাখবে তাঁদের স্মৃতি। কেউ ভুলবে না জানালার পর্দা নেমে আসার মুহূর্তে তোলা শেষ ছবির বিষাদ।
তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, বিবিসি, এএফপি
Leave a comment