তীব্র উত্তেজনার ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে জ্বলছে যুদ্ধের শিখা। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলার সর্বশেষ পরিণতিতে আজ রাতে তেহরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি ভবনে ইসরায়েলের বিমান হামলা এবং ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে অন্তত তিনজন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এই উত্তেজনাকে ২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় সামরিক মুখোমুখি অবস্থান হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরের প্রশাসনিক ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। এতে ভবনটির একাংশ ‘সামান্য’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরানি আধাসরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই জানা যায়, ওই ভবনের নিচতলায় অবস্থিত প্রতিরক্ষা উদ্ভাবন ও গবেষণা দপ্তরের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে।
একই সময়ে রাজধানীর শাহরান এলাকায় অবস্থিত একটি জ্বালানি অবকাঠামোয়ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনার বরাতে জানা যায়, ইসরায়েলি হামলায় ওই ডিপোয় আগুন লাগে, তবে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠছে এবং ঘটনাস্থলের আশপাশে আতঙ্কে ছুটছে সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে ইরানও পাল্টা হামলায় পিছপা হয়নি। শুক্রবার রাত থেকেই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক হামলা চালানো হচ্ছে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে। আজ দ্বিতীয় দিনের মতো চলমান এই হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে গ্যালিলি এলাকার পশ্চিমে একটি দোতলা ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে ধসে পড়ে। ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে এক তরুণী নিহত হন। পরে আরও দুইজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা এমডিএ।
এ হামলার প্রেক্ষিতে পুরো ইসরায়েলজুড়ে বেজে উঠেছে বিপদের সাইরেন। হাইফা, তামরা, আশকেলনসহ বিভিন্ন শহরে আকাশে দেখা গেছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহতের দৃশ্য। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বাসিন্দাদের সুরক্ষিত স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেয়, যদিও রাতের শেষভাগে তা তুলে নেওয়া হয়।
এই সংঘাত এখন শুধুই দুই দেশের সীমিত সামরিক লড়াই নয়। এতে সরাসরি কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক পর্যায়ে। ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের চলমান পারমাণবিক আলোচনা ছয় দফায় এসে স্থগিত হয়ে গেছে। ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানায়। ইরান স্পষ্ট করে বলেছে, এমন পরিস্থিতিতে কোনো আলোচনাই বাস্তবসম্মত নয়। ইসরায়েলের একের পর এক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে আলোচনার অর্থই নেই।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, যত দিন প্রয়োজন, ইরানে হামলা চলবে। তিনি এ-ও বলেন, ‘ইরানের প্রতিটি সামরিক ও জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা চালানো হবে।’ তাঁর ভাষায়, এই যুদ্ধ শুধু ইরানকে রুখে দেওয়ার জন্য নয়, বরং এই শাসনব্যবস্থাকে বদলে দেওয়ার লড়াই। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চাওয়ার বার্তা দিয়েছেন তিনি।
এর জবাবে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর (আইআরজিসি) এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের হামলায় ইসরায়েলের জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি আগ্রাসন বন্ধ না হয়, তাহলে তাদের ‘জবাব আরও তীব্র ও বিস্তৃত’ হবে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরি বৈঠকে উভয়পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। পোপ চতুর্দশ লিও সরাসরি মন্তব্য করে বলেন, ‘কারও অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলা কোনো ধর্ম বা মানবিক মূল্যবোধে সমর্থনযোগ্য নয়।’ অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে এই ইস্যুতে ফোনালাপ হয়েছে বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
এই যুদ্ধ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রূপ নিচ্ছে এক ‘প্রপাগান্ডা সংঘাতে’। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক্সে পোস্ট করেছেন, “তেহরান জ্বলছে।” আর ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের এক্স অ্যাকাউন্টে পাল্টা পোস্ট, “তেল আবিব জ্বলছে”— সঙ্গে যুক্ত রকেটের ইমোজি। দুই পক্ষই সাইবার যুদ্ধের মাঠে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া।
পরিস্থিতির আরও জটিলতা তৈরি করেছে আকাশসীমা ব্যবস্থাপনা। সিরিয়া ও জর্ডান উভয় দেশ তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সিরিয়ার আকাশে কোনো ফ্লাইট চলাচল করবে না। জর্ডান জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তাদের আকাশসীমাও বন্ধ থাকবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—এই সংঘাত কোথায় গিয়ে থামবে? মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু আঞ্চলিক নয়, বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে। এদিকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ফোন করে শান্তির বার্তা দিয়েছেন। তবে একইসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইসরায়েল প্রতিনিয়ত নাশকতা করে শান্তির উদ্যোগকে ধ্বংস করছে।
আজ রাতের মতো পরিস্থিতি কিছুটা স্থির হলেও তেহরান, তেল আবিব, হাইফা, গ্যালিলি বা জর্ডানের আকাশ— কোথাওই নিশ্চয়তা নেই আরেক দফা বিস্ফোরণের। নতুন দিনের ভোর কী বার্তা নিয়ে আসবে, কেউ জানে না। তবে এ সংঘাত যে দীর্ঘস্থায়ী, এবং প্রতিটি রকেটের নিচে চাপা পড়ছে কূটনীতি, মানবতা ও শান্তির সব সম্ভাবনা— তাতে সংশয় নেই কারো।
Leave a comment