ঢাকা মহানগরী দিন দিন কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হলেও পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, সংকীর্ণ রাস্তা, পুরোনো ভবন, দাহ্য পণ্যের গুদাম ও খোলা স্থানের চরম ঘাটতি রাজধানীকে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজ পরিচালনার সক্ষমতাও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা।
বিখ্যাত গবেষণা জার্নাল সায়েন্স ডাইরেক্ট-এ প্রকাশিত “An Assessment of Physical Aspects for Seismic Response Capacity in Dhaka, Bangladesh” শীর্ষক গবেষণায় রাজউকের জিআইএস ডাটাবেজ ব্যবহার করে ঢাকার ৩২টি এলাকার ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। এতে ১৫টি অঞ্চলকে ‘ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ’ বা অতি-উচ্চঝুঁকির এলাকার তালিকায় রাখা হয়েছে।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ১৫টি এলাকা- সবুজবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, উত্তরা, সূত্রাপুর, শ্যামপুর, মানিকদী, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, খিলগাঁও।গবেষণা বলছে, এসব এলাকায়—পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের আধিক্য, বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণ, ভবনের অত্যধিক ঘনত্ব,অত্যন্ত সংকীর্ণ সড়ক, পর্যাপ্ত হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও জরুরি সেবা না থাকা,খোলা স্থানের অভাব ,দাহ্য পণ্যের গুদামের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ ও সবুজবাগ রাজধানীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল।এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যধিক, রাস্তা সরু, ভবন পুরোনো, আর খোলা জায়গার প্রায় অনুপস্থিতি বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদ্ধারকাজও হবে কঠিন।সূত্রাপুর ও শ্যামপুরকেও উচ্চঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে ।
কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী ও মানিকদী—এই এলাকাগুলোতে সংকীর্ণ রাস্তা ও এলোমেলো বসতি পরিকল্পনার অভাবই বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।পল্লবীতে হাসপাতালের ঘাটতি থাকায় ভূমিকম্প-পরবর্তী চিকিৎসা ও উদ্ধারব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে বলে গবেষণা বলছে।
এদিকে মোহাম্মদপুর ও উত্তরা তুলনামূলক আধুনিক এলাকা হলেও খোলা স্থানের তীব্র অভাব ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়েছে। পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণের কারণে গুলশানকে তুলনামূলক নিরাপদ হিসেবে দেখা হয়েছে। প্রশস্ত রাস্তা, খোলা স্থান ও শক্তিশালী আধুনিক নির্মাণসামগ্রী এর প্রধান কারণ।
রমনা, শাহবাগ, আজিমপুর, ধানমন্ডি ও শেরে বাংলা নগর এলাকাও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ শহরের বড় খোলা স্থানগুলো দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। নিউমার্কেট, মতিঝিল ও লালবাগকেও কম ঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে—পরিকল্পিত নগরায়ণ ও লালবাগ কেল্লার বড় খোলা জায়গা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)–এর সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,“কোনো এলাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি নির্ভর করে দুই বিষয়ের ওপর—সেই এলাকার মাটির ধরন এবং ভবন নির্মাণ কতটা নিয়ম মেনে হয়েছে। মাটি ভালো হলেও যদি পুরোনো বা নিয়মবহির্ভূত ভবন থাকে, তাহলে এলাকাটি উচ্চঝুঁকিতে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ বন্ধ করার বিকল্প নেই।
Leave a comment