আজকের অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু এর শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫৪ সালে, যখন ঢাকায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়েছিল একটি ছোট পরিসরের বইমেলা। এটি শুধু একটি বই বিক্রির আয়োজনই ছিল না; বরং ছিল ভাষা ও সাহিত্য আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রত করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের দুই বছর পর, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি চত্বর) আয়োজিত হয় প্রথম বইমেলা। ভাষা আন্দোলনের আবেগ তখনও তাজা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ ছিল প্রবল। সেই সময় ঢাকার শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা একত্রিত হয়ে আয়োজন করেন এ মেলা, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা বইয়ের প্রচার-প্রসার বাড়ানো এবং পাঠকদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করা।
এই বইমেলার আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন সাহিত্যিকরা। সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জ্ঞানতাপস ড. এনামুল হকসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এবং প্রকাশকরা এতে যুক্ত ছিলেন। প্রথমবারের মতো এমন উদ্যোগে লেখকদের বই প্রকাশ ও পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথম বইমেলায় অংশ নিয়েছিল মাত্র ২০-২৫টি প্রকাশনী, যার মধ্যে ছিল মওলানা আকরম খানের ইসলামিয়া লাইব্রেরি, এমদাদিয়া লাইব্রেরি, বিদ্যার্থী প্রকাশনী ও আহমদ পাবলিশিং হাউস। বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০, যা প্রধানত বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কিত। শিক্ষার্থী, সাহিত্যিক ও সাধারণ পাঠকেরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে মেলায় অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে নতুন প্রজন্মের হাতে বাংলা বই তুলে দেওয়ার এ উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বই বিক্রির পাশাপাশি ছিল সাহিত্য আলোচনা, কবিতা পাঠের আসর, এবং বই প্রকাশের পরিকল্পনা।
১৯৫৪ সালের এই ছোট বইমেলাই পরবর্তী সময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র পথ সুগম করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা তৈরি হয় এখান থেকেই। এরপর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমি একে নিয়মিত আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এর আনুষ্ঠানিক রূপ দেয় বাংলা একাডেমি।
প্রথম বইমেলার সফল আয়োজনই আজকের বিশাল ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। আজ এটি কেবল একটি বইমেলা নয়; এটি এক মাসব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে এই আয়োজন। ১৯৫৪ সালের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যদি না থাকত, তাহলে হয়তো এত বিশাল পরিসরে বাংলা ভাষার এই সেরা উৎসব গড়ে উঠত না।
১৯৫৪ সালের ঢাকার প্রথম বইমেলা ছিল একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ, যা পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিক ও পাঠকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করে। এটি শুধুমাত্র বই বিক্রির আয়োজন ছিল না; বরং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার এবং সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজকের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সাফল্যের মূলে রয়েছে সেই প্রথম বইমেলার অগ্রণী ভূমিকা, যা বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
Leave a comment