যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক পর্বে জোহরান মামদানির বিস্ময়কর জয় শুধু মার্কিন রাজনীতিতে নয়, ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী সমাজের মধ্যেও এক আলোড়নের জন্ম দিয়েছে। মুসলিম, ফিলিস্তিনপন্থী ও প্রগতিশীল পরিচয়ের কারণে মামদানিকে এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেটে পরিণত হতে হচ্ছে—বিশেষত তাঁর ভারতবিরোধী অবস্থান, গুজরাট দাঙ্গা প্রসঙ্গে মোদিকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলা, ও রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। নিউইয়র্কের জনসমর্থন নিয়ে উঠে আসা এই তরুণ রাজনীতিককে এখন যে ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, তা শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়, বরং একপ্রকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা।
গত সপ্তাহে কুইন্সে এক অনুষ্ঠানমঞ্চে ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী বক্তা কাজল শিংগালা মামদানিকে ‘জিহাদি জম্বি’ আখ্যায় দেন এবং তাঁকে মেয়র নির্বাচিত করা হলে নিউইয়র্ককে আরেকটি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা তোলেন। শিংগালা তাঁর বক্তব্যে মুসলিম পুরুষদের ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও ‘লাভ জিহাদি’ বলে চিহ্নিত করেন, যা তাঁর পূর্বের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডেরই ধারাবাহিকতা। অনুষ্ঠানে গুজরাটি সমাজ, নিউইয়র্কের বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন এবং ব্রাহ্মণ সমাজের উপস্থিতি বিষয়টিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে—বিদ্বেষমূলক বক্তব্য যেন সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।
প্রচারণায় ‘গ্লোবাল ইন্তিফাদা থেকে এনওয়াইসি বাঁচাও’ স্লোগানসহ আকাশে ব্যানার ওড়ানো, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ও হিন্দু দেবতাদের অবমাননার মিথ্যা অভিযোগের পেছনে কাজ করছে প্রবাসী হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্ক। বিজেপিপন্থী ও ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এই নেটওয়ার্কের সম্পর্ক এখন প্রকাশ্য। মামদানির জয় যেন এই জোটের জন্য এক বিপদসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে—যেখানে হিন্দুত্ববাদ, জায়নিজম ও ট্রাম্পবাদ মিলে এক বৈশ্বিক ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতির রূপরেখা দাঁড় করাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আক্রমণ কেবল ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়; এটি সেই পুরোনো জাতিগত আধিপত্যের ধারণার পুনরুত্থান, যেখানে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভূমি, সম্পদ ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বকে রক্ষা করার নামে অন্যদের দমন বৈধ বলে মনে করা হয়। ভারতের হিন্দুত্ববাদ ও ইসরায়েলের জায়নিজম, উভয়ই এমন এক জাতিগত জাতীয়তাবাদের ধারক, যা মুসলিমদের শত্রু হিসেবে তুলে ধরে তাদের বৈধতা কেড়ে নিতে চায়।
মামদানিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঘৃণার এই প্ল্যাটফর্ম ভারতের মধ্যবিত্ত অভিবাসীদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করছে। যদিও কার্নেগি ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, অধিকাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন—এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ও—এই ঘৃণা ও চরমপন্থাকে সমর্থন করে না, তথাপি মূলধারার হিন্দু সংগঠনগুলো যখন এদের মঞ্চ দেয়, তখন স্পষ্ট হয়, যুক্তরাষ্ট্রেও হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামো গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে।
এক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নীরবতা, ট্রাম্পের খোলাখুলি আক্রমণ এবং নেতানিয়াহুর বিদ্বেষী মন্তব্য একটি বিপজ্জনক দিক নির্দেশ করে—যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের ভেতরেও ‘ঘৃণার রাজনীতি’ এখন আর আমদানি পণ্য নয়, বরং নিজস্ব উৎপাদনে পরিণত হচ্ছে।
তবুও মামদানি তাঁর অবস্থান থেকে একচুল সরছেন না। তাঁর প্রগতিশীল নীতিমালা, অভিবাসীবান্ধব পরিকল্পনা ও গণপরিবহন সংস্কারের প্রতিশ্রুতি তাঁকে শহরের সাধারণ মানুষের চোখে এক সাহসী কণ্ঠস্বর করে তুলেছে।
অ্যামেরিকার ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে, জোহরান মামদানি হয়ে উঠেছেন সেই প্রতিবাদী প্রতীক, যাঁর বিরুদ্ধে কট্টর ডানপন্থার এত ভয়—কারণ তিনি একা নন, বরং হাজারো বৈচিত্র্যময় নিউইয়র্কবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এগোচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই
Leave a comment