গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর শুরু হওয়া মামলাগুলো নিয়ে নানা অনিয়ম, অবিচার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের দুলাল রবিদাসের ঘটনা গোটা পরিস্থিতির নগ্ন চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। হাসপাতালের দেয়া সনদ অনুযায়ী দুলাল স্ট্রোকে মারা গেলেও তাঁকে ‘আন্দোলনের সহিংসতায় নিহত’ দেখিয়ে হত্যা মামলা করা হয়। সেই মামলায় অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনসহ মোট ৭৬৮ জনকে আসামি করা হয়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ ধরনের মামলায় উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো, চাঁদাবাজি ও ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটানো। দুলালের স্বজনরা জানান, তাঁর মৃত্যুর সময় ও স্থানসংক্রান্ত মামলার বর্ণনা ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। এমনকি দুলালের পরিবার লিখিতভাবে জানিয়েছিল, তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুরো দেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের জেরে অন্তত ১,৪৯৯টি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ৫৯৯টি হত্যা মামলা। মোট গ্রেপ্তার হয় ১০ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু তদন্তে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের পাশাপাশি অনেক নিরীহ নাগরিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী এবং এমনকি অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে ৪০টি মামলার বিশ্লেষণে উঠে আসে, অনেক জায়গায় স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মী, কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য, আইনজীবী ও দালালচক্র মিলে মামলা বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। অনেককে মামলায় জড়ানোর পেছনে ছিল ব্যক্তিগত বিরোধ, আর্থিক স্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক শত্রুতা। আসামিদের তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে গড়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হতো। কোথাও কোথাও বাদী নিজেরাও বলছেন, তাঁদের দিয়ে স্রেফ সই নেওয়া হয়েছে, আসামির তালিকা প্রস্তুত করেছেন অন্যরা।
কিশোরগঞ্জের বাবুল মিয়া ও সাইফুল ইসলাম নামের দুই নিরীহ কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁদের একাধিক মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয় এবং টাকা না দেয়ায় তাঁদের বারবার আসামি করা হয়।
আইন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোও (যেমন BLAST) বলছে, এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষ হয়রানি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও মাঠপর্যায়ে হয়রানি কমেনি।
আইজিপি বাহারুল আলম জানিয়েছেন, নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি কমাতে সারাদেশে মেন্টরিং ও মনিটরিং দল গঠন করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে উঠে আসে, এখনও নিরীহ ব্যক্তিদের নামে একাধিক মামলা চলছে। কোথাও কোথাও জামিনের পরও নতুন মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জুলাই আন্দোলনে সরাসরি সহিংসতায় জড়িত অনেক অপরাধী এখনো অধরা রয়ে গেছে, অথচ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য শত শত নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অবৈধ সুবিধা আদায় করতে অনেক জায়গায় ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসে এসব ‘মামলা বাণিজ্য’ হয়ে রইল আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়, যেখানে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
Leave a comment