গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় বিতরণ করা একটি ত্রাণের বাক্সে কী থাকে? উত্তরটা হলো—চার কৌটা টুনা মাছ, ছয় প্যাকেট স্প্যাগেটি, এক লিটার তেল, দুই কেজি চাল, চার কেজি আটা, এক কেজি শিম, একটি আঙুরপাতা মোড়ানো খাবার, এক বোতল অ্যাপ্রিকট জেলি, এক বাক্স বিস্কুট, এক বাক্স টি-ব্যাগ। তবে এসব খাবারের পরিমাণ গাজার বিপর্যস্ত জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই নগণ্য যে, বিতরণকৃত প্রতিটি বাক্সকে ঘিরেই এখন উঠছে বিতর্ক।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় খাদ্যের জন্য অপেক্ষমাণ হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মধ্যে এই ত্রাণ বিতরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল অনুমোদিত একটি বিতর্কিত সংগঠন—গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। এই সংস্থার দাবি, তারা ১৪ হাজার খাদ্যবাক্স বিতরণ করেছে। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর ভাষ্য, এই সংখ্যাটি গাজায় বিরাজমান গণ-অনাহারের প্রেক্ষাপটে একেবারেই অপ্রতুল।
খাদ্য সংগ্রহের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মানুষ যখন জিএইচএফের বিতরণ কেন্দ্রে ছুটছে, তখন সেই ভিড়েই প্রাণ হারাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। এ পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ঘিরে সংঘটিত বিশৃঙ্খলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও বহু ক্ষুধার্ত নারী, শিশু ও পুরুষ।
জিএইচএফের বিতরণকেন্দ্রগুলো পাহারা দিচ্ছে মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীরা। এই কেন্দ্রগুলোর অবস্থান এককেন্দ্রিক ও দুর্ভোগপূর্ণ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ফাউন্ডেশনটি। আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর অভিযোগ, এই ব্যবস্থায় শুধু গাজাবাসীদের নয়, বরং ত্রাণ বিতরণের প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, হামাস যাতে ত্রাণ লুট করতে না পারে, সে জন্যই গাজায় খাদ্য প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যারা ত্রাণ নিচ্ছেন, তারা মূলত অসহায় ফিলিস্তিনি নাগরিক। এই চুরি কোনো সংঘটিত অপারেশনের অংশ নয়, বরং মরিয়া মানুষের জীবনের জন্য চালানো সংগ্রাম।
ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, বিতরণকৃত খাদ্যবাক্সগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অসম্পূর্ণ ও অপ্রতুল। মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলা অনেকেই জানান, এসব বাক্সে নেই শিশুখাদ্য, দুধ, ডায়াপার, ওষুধ, রান্নার জ্বালানি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী বা নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি পণ্য। জীবনধারণে প্রয়োজনীয় মৌলিক উপকরণ ছাড়াই বিতরণ করা এই ত্রাণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও।
গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন নামে এই সংস্থাটি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত হয়েছে। তবে এর নেতৃত্ব কে দিচ্ছে, কীভাবে অর্থায়ন হচ্ছে—তা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তাকর্মী ও ত্রাণ সংক্রান্ত পেশাজীবীরা এটি পরিচালনা করছেন। কিন্তু যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলে তাদের পূর্ববর্তী কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-র প্রধান এই বিতরণব্যবস্থাকে মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী উল্লেখ করে বলেন, এই মডেলটি ইসরায়েলের মানবিক বিপর্যয়কে আড়াল করার প্রয়াসমাত্র। তার মতে, “এটি নৃশংসতা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরানোর চেষ্টা।”
ফিলিস্তিনিরা এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফিরছে শুধু বেঁচে থাকার মতো কিছু খাবারের আশায়। রাফার সরকারি স্কুল প্রাঙ্গণ কিংবা খান ইউনিসের তাঁবু থেকে বিতরণকেন্দ্র পর্যন্ত দীর্ঘ পথ—সবখানেই কেবল বেঁচে থাকার জন্য নিঃস্ব মানুষের কষ্টের উপাখ্যান।
এমন এক মুহূর্তে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আবদুল্লাহ সুলেমান আল-সাদুদি যখন বলেন, “আমরা শুধু আমাদের সন্তানদের খাওয়াতে চাই”—তখন তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় গোটা গাজার আকুতি।
ত্রাণ নয়, এখন গাজার দরকার সম্মানজনক বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার নামে প্রহসন নয়, চাই ন্যায্য ও মানবিক সহায়তা।
Leave a comment