সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও দক্ষিণাঞ্চলীয় সুয়েইদায় বিস্তৃত হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত বুধবার মধ্য দামেস্কে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছাকাছি একাধিক স্থানে বিমান হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলাগুলোতে তিনজন নিহত ও অন্তত ৩৪ জন আহত হয়েছেন বলে সিরীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, তাদের লক্ষ্য ছিল সিরিয়ায় সংখ্যালঘু দ্রুজ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা এবং সরকারপন্থী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া, যারা এই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
দ্রুজ গোষ্ঠী সিরিয়া ও ইসরায়েল উভয় দেশেই এক গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে এই গোষ্ঠীর বহু সদস্য রয়েছে এবং দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই দ্রুজদের নিজের মিত্র হিসেবে দেখে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে সুয়েইদায় সিরীয় সরকারি বাহিনী, দ্রুজ যোদ্ধা এবং স্থানীয় বেদুইন গোত্রের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছিল। এই অবস্থায় ইসরায়েল দাবি করে, তারা সংঘর্ষপ্রবণ অঞ্চল থেকে সরকারপন্থী হামলাকারীদের হটানোর জন্য এই অভিযান চালায়।
তবে সিরিয়া এই দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একে “নগ্ন আগ্রাসন” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ছিল সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার হীন চেষ্টা। তাদের ভাষায়, এই হামলা ছিল ‘ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙনের একটি পরিকল্পিত নীতি।’
দামেস্কে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনে সরাসরি দুটি বড় আকারের বিমান হামলা চালানো হয়। স্থানীয় সময় দুপুর তিনটার দিকে এই হামলাগুলো ঘটে। হামলায় ভবনের প্রবেশপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শহরের আকাশে কালো ধোঁয়ার মেঘ দেখা যায়। সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের পাশেও হামলা চলে। আল–জাজিরার রিপোর্টার জেইনা খোদর বলেন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়।
একই সময় সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েইদা শহরেও হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এই শহরটি জর্ডান সীমান্তের খুব কাছাকাছি এবং মূলত দ্রুজ অধ্যুষিত। সেখানে সম্প্রতি সরকার ও দ্রুজ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। পাল্টাপাল্টি অপহরণ, আক্রমণ এবং বেসামরিক মানুষের ওপর সরাসরি সরকারি বাহিনীর হামলার অভিযোগ ছিল। সরকার সুয়েইদায় শান্তি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুজদের এক অংশ ইসরায়েলের সমর্থনকে স্বাগত জানালেও অন্য অংশ চায় না যে ইসরায়েল তাদের পক্ষ হয়ে হস্তক্ষেপ করুক। এই দ্বিধার মধ্যেই হিকমাত আল-হিজরি নামের এক দ্রুজ নেতা যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করেন। অপরদিকে, ইয়াসের জারবু জানান, সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে তাদের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল চায় না, সিরিয়া একটি কেন্দ্রীভূত শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠুক। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের প্রভাব বজায় রাখা কৌশলগতভাবে জরুরি, বিশেষ করে গোলান মালভূমির দখল ও সুয়েইদার মতো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে।
সিরিয়ার নতুন সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তবে সুয়েইদার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তারা সঠিকভাবে সফল হতে পারছে না। ইসরায়েল সেই দুর্বলতাকেই ব্যবহার করে হামলা জোরদার করেছে। এ ছাড়া সুয়েইদা ইসরায়েল ও জর্ডান সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় অঞ্চলটি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী কিছু এলাকায় সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়া নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিভিন্ন আরব দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। সিরিয়ার অভিযোগ, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং জাতিসংঘ সনদের বিরোধী কাজ করছে।
এই হামলার পরে সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় এবং সেনাবাহিনী কিছু এলাকায় পিছু হটতে শুরু করে। তবে পরিস্থিতি এখনো থমথমে এবং ভবিষ্যতে আবারও সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
বিশ্লেষক আম্মার কাহফ বলেন, “ইসরায়েল কখনোই চায় না, সিরিয়া একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক। বরং দেশটিকে দুর্বল রেখে নিজের কৌশলগত নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের নীতিই ইসরায়েল অনুসরণ করছে।”
সূত্র: আল জাজিরা
Leave a comment