বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের গাংগাটিয়া গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব ইতিহাস—গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি, যা বর্তমানে পরিচিত ‘মানব বাবুর বাড়ি’ নামে। বহু জমিদার বাড়ি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এই জমিদার বাড়িটি আজও অক্ষত। কারণ, এই বাড়িতে এখনো বসবাস করছেন জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘মানব বাবু’ নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন ভোলানাথ চক্রবর্তী। তার উত্তরসূরিরাই যুগের পর যুগ ধরে এখানে বাস করে এসেছেন। দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও, মানব বাবুর পরিবার এ বাড়িতে থেকে গেছেন নিঃশব্দে, সম্মানের সঙ্গে।
বর্তমানে মানব বাবু তার স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে এই শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িতে বসবাস করছেন। পরিবারে আর কোনো সন্তান নেই। তার পরলোকগত ভাইদেরও কোনো সন্তান নেই, ফলে এই জমিদার বংশের ধারাবাহিকতা এখানেই থেমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গাংগাটিয়া জমিদার পরিবার ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত—ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন এক জাতি। এ বংশের মানুষ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান। তাদের আদি বাসস্থান ছিল ভারতের ‘কাইন্নকব্জি’ নামক স্থানে। প্রায় ছয় শত বছর আগে তারা হোসেনপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ব্রিটিশ আমলে জমিদারি লাভ করেন।
বিলুপ্তপ্রায় জমিদার ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে মানব বাবু এখনো তার পূর্বপুরুষের সেই ঐতিহ্য লালন করে যাচ্ছেন। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং তার প্রতি এলাকাবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আজও অটুট।
এই জমিদার বাড়িটি কেবল একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস—যা বাংলা উপমহাদেশের জমিদার প্রথার গৌরব, পতন এবং ঐতিহ্যকে একত্রে ধারণ করে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই জমিদার বাড়িকে দেখছেন অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের এক মূল্যবান সুযোগ হিসেবে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বাড়ির সংরক্ষণ ও মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জীবনচর্চা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলার জমিদার ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তুলতে পারে।
কালের করাল গ্রাসে যখন অধিকাংশ জমিদার বাড়ি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, তখন মানব বাবুর এই নিঃশব্দ উপস্থিতি যেন একটি বিরল আলোকবর্তিকা, যা ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে দৃঢ়তার সঙ্গে।
Leave a comment