ফরিদপুরে নার্স হত্যা মামলায় আড়াই বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েই আবারও ছিনতাই ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন শরিফুল ইসলাম ওরফে ডন শরীফ (৩৮)। শেষ পর্যন্ত র্যাবের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাব-১০ এর অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. কামরুজ্জামান।
তার সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন সহযোগী রায়হান মোল্লা (২৫)। তাদের কাছ থেকে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ এলাকা থেকে চুরি করা একটি আর ওয়ান মোটরসাইকেল, একটি খেলনা পিস্তল, সুইচ গিয়ার চাকু, ক্ষুর, কেঁচি এবং দেড় কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
শরিফুল ইসলাম ডন ফরিদপুর শহরের বাইপাস সড়কের কবিরপুর এলাকার মৃত আলী ফারুক শেখের ছেলে। র্যাবের তথ্যানুসারে, তিনি একজন চিহ্নিত পেশাদার অপরাধী, যিনি কিশোর বয়স থেকেই চুরি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। র্যাব-১০ জানায়, তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০টি ছিনতাই মামলা দায়ের রয়েছে। অতীতে চারবার গ্রেফতার হয়েও তিনি মুক্তির পর পুনরায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফিরে যান।
অ্যাডিশনাল ডিআইজি কামরুজ্জামান বলেন, “ডন শরীফ নিজেকে খুব চালাক মনে করতেন। কোনো অপরাধের পর দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে অবস্থান গোপন রাখতে পারতেন। সাধারণত তিনি ভোরবেলা ছিনতাই করতেন, যখন রাস্তায় মানুষজন কম থাকে।”
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি শরীফ অনলাইনে মোটরসাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতা সেজে এক বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মোটরসাইকেল ট্রায়াল দেওয়ার কথা বলে সেটি চালিয়ে নিয়ে গিয়ে আর ফেরেননি। চুরি করা মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়েছে এবং এটি তার সাম্প্রতিক অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গ্রেফতারের সময় র্যাব সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন,“স্যার, আমাকে গ্রেফতার করলেন কীভাবে?” র্যাব কর্মকর্তারা জানান, এটি তার আত্মবিশ্বাস ও অপরাধজগতের সঙ্গে দীর্ঘ অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন। র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, গত ২১ অক্টোবর ফরিদপুরের শোভারামপুর এলাকায় এক গৃহবধূ বাড়ির সামনে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। সে সময় দুই যুবক মোটরসাইকেলে এসে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে তার দুটি কানের দুল ছিনিয়ে নেয়।
ঘটনার পর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। র্যাব-১০ এর তদন্তে দেখা যায়, সেই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ডন শরীফ। ওই মামলার সূত্র ধরেই তার অবস্থান শনাক্ত করে র্যাবের দল সালথা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। ডন শরীফের নাম আলোচনায় আসে ২০১৮ সালের অরুনিমা ভৌমিক হত্যাকাণ্ডে। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স অরুনিমা ভৌমিক রিকশায় করে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। পথে ছিনতাইকারীরা তার ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নিতে গেলে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।
গুরুতর আহত অরুনিমা কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান। সেই ঘটনায় পুরো ফরিদপুর জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তদন্তে তৎকালীন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ‘হেলমেট বাহিনীর’ কয়েকজন সদস্যের সম্পৃক্ততা প্রকাশ পায়, এবং প্রধান আসামি হিসেবে ডন শরীফ গ্রেফতার হন।
র্যাব-১০ এর অ্যাডিশনাল ডিআইজি কামরুজ্জামান জানান, “ডন শরীফ ফরিদপুরের অপরাধ জগতের পরিচিত নাম। সে চুরি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিচালনা করত। তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “তাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে আমরা এই অঞ্চলে সক্রিয় অপরাধচক্রের একটি বড় অংশকে শনাক্ত করতে পেরেছি। আরও কয়েকজন সহযোগীর খোঁজ চলছে।” ডন শরীফের পুনরায় গ্রেফতার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একদিকে সাফল্য, অন্যদিকে একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়ে দিয়েছে—পুরনো অপরাধীরা শাস্তি ভোগের পরও অপরাধপ্রবণতা থেকে সহজে সরে আসছে না।
Leave a comment