বিশ্বজয়ী আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির বহুল আলোচিত তিন দিনের ভারত সফরের শুরুটাই হলো চরম বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। কলকাতার সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেসির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তার দীর্ঘদিনের সতীর্থ লুইস সুয়ারেজ ও আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পল। কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের উৎসবমুখর প্রত্যাশা খুব দ্রুতই রূপ নেয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে, যা শেষ পর্যন্ত পুলিশি লাঠিচার্জ ও রাজনৈতিক বিতর্কে গিয়ে ঠেকে।
অনুষ্ঠানকে ঘিরে সকাল থেকেই যুবভারতী স্টেডিয়ামের আশপাশে ছিল উপচে পড়া ভিড়। মোটা অঙ্কের টিকিট কেটে হাজার হাজার দর্শক গ্যালারিতে জায়গা নেন, এক ঝলক প্রিয় তারকাকে দেখার আশায়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেসি মাঠে প্রবেশ করার পরপরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন ব্যক্তি—যাদের মধ্যে স্থানীয় মন্ত্রী, বিভিন্ন সংস্থার কর্তা ও ভিআইপি অতিথিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—মেসিকে ঘিরে ধরেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিআইপিদের অনেকেই মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা হাতে সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীরাও তাদের সরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে পুরো পরিস্থিতি নির্বিকারভাবে সামলানোর চেষ্টা করেন, যা কার্যত ব্যর্থ হয়। এর ফলে মাঠে উপস্থিত সাধারণ দর্শকরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের প্রিয় ফুটবল আইকনকে স্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ পাননি।
গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকদের মধ্যে দ্রুত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই টিকিটের মূল্য ও আয়োজনের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত দর্শকদের একটি অংশ মাঠের ভেতরে বোতল ও ভাঙা চেয়ার ছুড়ে মারতে শুরু করেন। কেউ কেউ নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে মাঠে ঢোকারও চেষ্টা করেন। মুহূর্তের মধ্যে পুরো স্টেডিয়াম কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। দর্শকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিরাপত্তার অভাবে নিজেদের ঝুঁকির মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নিরাপত্তাজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ ও রদ্রিগো ডি পলকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত। ঘটনার পর কলকাতা পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। পরে বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়োজন সংক্রান্ত একাধিক ত্রুটি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতির কথা উঠে এসেছে। গ্রেপ্তারের পর শতদ্রু দত্ত দর্শকদের টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়ার লিখিত আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এদিকে, মেসির অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এক বিবৃতিতে ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, এমন একটি আন্তর্জাতিক মানের আয়োজন আরও ভালোভাবে পরিচালনা করা যেত। তবে তার এই ক্ষমা প্রার্থনা রাজনৈতিক বিতর্ক থামাতে পারেনি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে তীব্র সমালোচনায় মুখর হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “এই ব্যর্থতার দায় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনারের। প্রকৃতপক্ষে তাদেরই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল।” তার এই মন্তব্য নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং বিষয়টি রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
ঘটনার পর যুবভারতী স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভিআইপি প্রবেশাধিকার এবং দর্শক ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক ফুটবলপ্রেমী ও ক্রীড়া সংগঠক দাবি করছেন, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া আয়োজন সফল করতে হলে স্বচ্ছ পরিকল্পনা, কঠোর নিরাপত্তা ও ভিআইপি হস্তক্ষেপ সীমিত করা জরুরি।
Leave a comment