ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় ওয়াক্ফ (সংশোধনী) আইন বাতিলের দাবিকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ধূলিয়ান, সুতি, জঙ্গিপুরসহ একাধিক এলাকায় উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত তিনজন, আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। সহিংসতা রুখতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে পুরো জেলায় মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী, যারা আজ সকাল থেকে রুট মার্চ শুরু করেছে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সমসেরগঞ্জের ৭২ বছর বয়সী হর গোবিন্দ দাস, তাঁর ছেলে চন্দন দাস (৪০) এবং সুতির ১৭ বছর বয়সী ছাত্র এজাজ আহমেদ সেখ। অভিযোগ উঠেছে, হর গোবিন্দ ও চন্দন দাসকে তাঁদের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক বের করে এনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, এজাজ আহমেদ বিক্ষোভে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মারা যান।
সারা জেলায় চলছে অচলাবস্থা। ধূলিয়ান, সুতি ও সমসেরগঞ্জে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, এমনকি একটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকেন্দ্র এবং একটি শপিং মলেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে পাথরের মজুতও উদ্ধার করেছে বিএসএফ, যা সহিংসতার পরিকল্পিত রূপের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক উত্তেজনাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পুরুলিয়ার বিজেপি সংসদ সদস্য জ্যোতির্ময় সিং মাহাত এই পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ ঘোষণা এবং সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ‘এএফএসপিএ’ (সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন) প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও রেহাই পাননি। ফারাক্কার তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম এবং জঙ্গিপুরের সংসদ সদস্য খলিলুর রহমান বিক্ষোভকারীদের তোপের মুখে পড়েন। তাঁদের বাড়িঘরে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী এই সহিংসতার জন্য সরাসরি ‘আনসারুল্লাহ বাংলা’ নামের একটি জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করেন। তিনি এ ঘটনায় রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি তোলেন। তাঁর ভাষায়, “এই বিক্ষোভে অন্তত ৩৫টি পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, বেসরকারি এবং সরকারি অসংখ্য যানবাহনে অগ্নিসংযোগ হয়েছে।”
তবে এ ঘটনায় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে।
এদিকে রাজ্য পুলিশের আইজি রাজীব কুমার শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “গুন্ডাবাজিকে কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাজ্যের সব পক্ষকে সংযত থাকার বার্তা দিয়েছেন।
এই সহিংসতা আর রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে এখন গোটা মুর্শিদাবাদ যেন আতঙ্কের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছে—এই দুঃস্বপ্নের যেন শিগগিরই অবসান হয়।
Leave a comment