বিমানের ডানায় ভর করে মানুষ স্বপ্ন দেখে দূর দেশে পৌঁছানোর। কিন্তু সেই ডানাই যদি বয়ে আনে মৃত্যুর বার্তা? এয়ার ইন্ডিয়া—যে প্রতিষ্ঠানকে ভারতের আকাশ পথের গর্ব বলা হয়, সেই একই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে জমে আছে ১৩০০’র বেশি প্রাণহানির মর্মান্তিক গল্প। ২০২৫ সালের ১২ জুন আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনগামী এআই ১৭১ ফ্লাইটের বিধ্বস্ত হওয়া, যেন স্মরণ করিয়ে দিলো এয়ার ইন্ডিয়ার অতীতের সেই সব কালো দিন, যেখানে আকাশ মানেই ছিল না ফেরার পথ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এয়ার ইন্ডিয়া ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পায়। টাটা গোষ্ঠীর হাত ধরে ১৯৩২ সালে ‘টাটা এয়ারলাইন্স’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে, যা ১৯৫৩ সালে জাতীয়করণ হয়ে হয় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় বিমান সংস্থা হিসেবে খ্যাত এয়ার ইন্ডিয়া আধুনিক প্রযুক্তির অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বোয়িং ৭৪৭ ও ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ব্যবহারে তারা ছিল অগ্রগামী। অথচ, এই উন্নত প্রযুক্তির আড়ালেই রয়ে গেছে একের পর এক দুর্ঘটনা, শোকাবহ ইতিহাস।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ১২ জুনের ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। পাইলট ‘মেডে’ সংকেত পাঠানোর পর মুহূর্তের মধ্যেই বিমানটি আহমেদাবাদের মেঘানিনগরের আবাসিক এলাকায় ভেঙে পড়ে। ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে পড়ে আগুন ও ধোঁয়া, আর মানুষের কান্না।
এটি প্রথম নয়। ১৯৪৭ সালে করাচিতে ঘটে প্রথম বড় দুর্ঘটনা। এরপর ১৯৫০ সালের ফ্রান্সের আল্পসে মালবার প্রিন্সেসের বিধ্বস্ত হওয়া, ১৯৬৬ সালে আল্পসে হোমি ভাবাসহ ফ্লাইট এআই ১০১-এর ধ্বংস, কিংবা ১৯৮৫ সালে কানিষ্কা বিমানে সন্ত্রাসী বোমা হামলায় ৩২৯ জনের মৃত্যু—সবই ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায়।
২০১০ সালে মঙ্গলুরুতে টেবিলটপ রানওয়েতে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৫৮ জনের মৃত্যু, আর ২০২০ সালে কোঝিকোডে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি—সবকিছু মিলিয়ে একটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে: নিরাপত্তা নাকি অবহেলা?
এয়ার ইন্ডিয়া শুধু একটি সংস্থা নয়, এটি ভারতের উচ্চাশার প্রতীক। কিন্তু সেই উচ্চাশা যদি প্রায়শই মৃত্যুতে পর্যবসিত হয়, তবে প্রশ্ন উঠবে নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা প্রোটোকল নিয়ে। প্রতিটি মৃত্যুই একটি পরিবারে অন্ধকার নামিয়ে আনে, আর প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষা কতটা জরুরি।
আজ যখন আকাশে উড়ে বেড়ায় এয়ার ইন্ডিয়ার রঙিন লোগো, তখন তার ছায়ায় আমরা যেন ভুলে না যাই ১৩০০ প্রাণের আর্তনাদ, যারা হয়তো চেয়েছিল পৌঁছাতে নতুন গন্তব্যে, কিন্তু রয়ে গেছে স্মৃতির ভস্মে। এয়ার ইন্ডিয়ার এই ইতিহাস একান্তই ভারতের নয়, এটি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্কবার্তা—যেখানে গর্বের পাশাপাশি থাকে উত্তরদায়িত্বের কঠিন প্রশ্ন।
Leave a comment