Home ইতিহাসের পাতা উসমানীয়দের কনস্টানটিনোপল জয়: ১৫০০ বছরের রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি
ইতিহাসের পাতা

উসমানীয়দের কনস্টানটিনোপল জয়: ১৫০০ বছরের রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

Share
Share


আজ থেকে ৫৭১ বছর আগে, ১৪৫৩ সাল এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল যা বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের নেতৃত্বে কনস্টানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয়লাভ করে উসমানীয় বাহিনী, যা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দীর্ঘ এক সহস্রাব্দব্যাপী শাসনের অবসান ঘটায়। এই বিজয় শুধু একটি শহরের পতন ছিল না, এটি ছিল একটি নতুন যুগের সূচনা এবং মধ্যযুগের সমাপ্তি। অনেক ঐতিহাসিক বিশ্লেষক মুসলমানদের কনস্টানটিনোপলের বিজয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি হিসেবে দেখেন।
তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্তাম্বুল আগে কনস্টান্টিনোপল নামে পরিচিত ছিল। এটি ছিল রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত শহরটি অবরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর চূড়ান্তভাবে শহরটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। তারও পূর্বে মহান সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানও শহরটি জয় করেছিলেন, কিন্তু এর দখল ধরে রাখতে পারেননি। কনস্টানটিনোপলের বিজয়কে ১৫০০ বছরের মতো টিকে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উসমানীয়দের এই বিজয়ের ফলে উসমানীয় সেনাদের সামনে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকল না। খ্রিস্টানদের জন্য এই শোচনীয় পতন ছিল অকল্পনীয়।
কনস্টানটিনোপল রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন কর্তৃক ৩৩০ সাল থেকে রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তী ১১ শতাব্দী যাবত শহরটি বেশ কয়েকবার অবরোধের সম্মুখীন হলেও ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ছাড়া এটি কেউ দখল করতে পারেনি। ক্রুসেডাররা কনস্টানটিনোপলকে ঘিরে একটি অস্থায়ী ল্যাটিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তবে সাম্রাজ্যের বাকি অংশ বেশ কিছু গ্রীক রাষ্ট্র, বিশেষ করে নাইসিয়া, এপিরাস ও ট্রেবিজন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই গ্রীকরা মিত্র হিসেবে ল্যাটিন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করলেও বাইজেন্টাইন মুকুটের জন্যও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। নাইসিয়ানরা ১২৬১ সালে কনস্টানটিনোপল অধিকার করে নেয়। দুর্বল এই সাম্রাজ্যে অল্প পরিমাণে শান্তি বিরাজ করছিল। এরপর ল্যাটিন, সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান ও উসমানীয় তুর্কিরা আক্রমণ করে। ১৩৪৬ থেকে ১৩৪৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ব্ল্যাক ডেথ বলে পরিচিত মহামারীতে শহরের প্রায় অর্ধেক অধিবাসী মৃত্যুবরণ করে। এছাড়াও দুই শতাব্দী আগে ক্রুসেডারদের আক্রমণে ফলে অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক আধিপত্য খর্ব হওয়ার কারণে লোকসংখ্যা কমছিল। ফলে ১৪৫৩ সালে শহরটি বড় মাঠ দ্বারা পৃথক করা কিছু দেয়ালঘেরা গ্রামের সমষ্টি ছিল। পুরো শহরটির চারদিক পঞ্চম শতাব্দীর থিওডোসিয়ান দেয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল। ১৪৫০ সাল নাগাদ সাম্রাজ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পড়ে। এসময় শহরের বাইরের কয়েক বর্গ মাইল, মারমারা সাগরের প্রিন্স দ্বীপ ও পেলোপন্নিস ও এর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিস্ট্রাস নিয়ে গঠিত ছিল। চতুর্থ ক্রুসেডের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট স্বাধীন ট্রেবিজন্ড সাম্রাজ্য কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে টিকেছিল।
১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ তার পিতার উত্তরাধিকারী হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সী একজন তরুণ শাসক হিসেবে কতটুকু যোগ্য তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠে। বলকান ও এজিয়ান অঞ্চলে তিনি খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো সফল ব্যক্তি হতে পারবেন না-বলেই সবার ধারণা ছিল। কিন্তু দিন যতই যেতে থাকে ততই তার প্রজ্ঞা ও কৌশল সবার সামনে স্পষ্ট হয়েছে। অভিনব রণকৌশল প্রয়োগ করে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেন একজন যোগ্য শাসক হিসেবে। সুলতান মুহাম্মদ সমুদ্রের দিক থেকে শহর অবরোধের জন্য একটি নৌবহর গড়ে তোলেন। এটি অংশত গেলিপোলির গ্রিক নাবিকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। উসমানীয়রা মাঝারি আকারের কামান তৈরীতে দক্ষ একথা অবরোধের আগে সবার জানা ছিল। কিন্তু গোলা ছোড়ার পাল্লা প্রতিপক্ষের ধারণার বাইরে চলে যায়। অস্ত্রের ক্ষেত্রে উসমানীয়দের এই সক্ষমতা উরবান নামক এক হাঙ্গেরিয়ান (কারো মতে জার্মান) ব্যক্তির কারণে সম্ভব হয়। তার নকশা করা একটি কামানের নাম ছিল “শাহি”। এটির দৈর্ঘ্য ছিল ২৭ ফুট (৮.২ মি) এবং এটি ৬০০ পাউন্ডের (২৭২ কেজি) একটি গোলা প্রায় এক মাইল (১.৬ কিমি) দূরে ছুড়ে মারতে পারত।
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও বালতুঘলুর অধীন উসমানীয় নৌবহরগুলো যখন গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করতে পারছিল না, তখন অভিনব বুদ্ধি মাথায় আসে সুলতান মুহাম্মদের। তিনি গোল্ডেন হর্নের উত্তরে গালাটার উপর দিয়ে চর্বি মাখানো কাঠের একটি রাস্তা তৈরির আদেশ দেন। অর্থাৎ, স্থলপথে নৌকা চালানোর অবিশ্বাস্য ঘটনা! জাহাজগুলোকে টেনে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাইজেন্টাইনদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। ২৮ এপ্রিল রাতে উসমানীয় জাহাজগুলো ধ্বংস করার একটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু উসমানীয়রা পূর্বে সংকেত পাওয়ায় খ্রিস্টান বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পিছু হটে। এভাবে নানা ঘটনা পরিক্রমায় মুসলমানদের হাতে পতন হয় কনস্টানটিনোপল। শুরু হয় ইস্তাম্বুলের নতুন ইতিহাস।
বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ তার রাজধানী এড্রিনোপল থেকে সরিয়ে কনস্টানটিনোপল বা ইস্তাম্বুলে নিয়ে আসেন। শহর অবরোধের আগে ও পরে শহরের বেশ কিছু গ্রীক ও অগ্রীক বুদ্ধিজীবী পালিয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ইতালিতে চলে যায় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁতে সাহায্য করে। কনস্টানটিনোপল জয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ শহরে প্রবেশ করেন এবং হাজিয়া সোফিয়া, যা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গির্জা ছিল, সেটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। এই বিজয় উসমানীয় সাম্রাজ্যকে একটি বিশ্বশক্তিতে পরিণত করে এবং এর প্রভাব ইউরোপ ও এশিয়ার রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যে সুদূরপ্রসারী হয়। এটি রেনেসাঁস এবং আবিষ্কারের যুগেও প্রভাব ফেলে, কারণ অনেক বাইজেন্টাইন পণ্ডিত এবং শিল্পী ইউরোপে পালিয়ে যান এবং তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন। কনস্টানটিনোপলের পতন ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা একটি সাম্রাজ্যের সমাপ্তি এবং আরেকটি সাম্রাজ্যের উত্থানকে চিহ্নিত করে, এবং এটি বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

মুসলিম প্রধান দেশ মরক্কোতে ঈদুল আজহায় কোরবানি নিষিদ্ধ

মরক্কো সরকার ঈদুল আজহাকে ঘিরে দেশজুড়ে পশু কোরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় জনমনে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের রাজকীয়...

ঈদেও সামান্য মাংসের স্বাদ পাবে না গাজার অধিকাংশ মানুষ

গাজার আকাশে হয়তো চাঁদ উঠবে ঈদের আগমনী বার্তা নিয়ে, কিন্তু ভাঙা ঘর, খালি হাড়ি আর ক্ষুধার্ত মুখগুলোর কাছে সে বার্তা শুধুই এক অদৃশ্য...

Related Articles

শুক্রবার ও শনিবারকে সরকারি ছুটি ঘোষণা আওয়ামী লীগ সরকারের

১৯৯৭ সালের ৩০ মে, এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সরকারি...

জিয়াউর রহমান: এক সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রনায়কের উত্থান 

ঢাকা, ৩০ মে ২০২৫: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম জিয়াউর রহমান,...

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরের এক সপ্তাহে কী ঘটেছিল বাংলাদেশে?

১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোরে চট্টগ্রামের এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন বিএনপির...

টাইটানিক না অলিম্পিক? বিমা কেলেঙ্কারি ও ফেডারেল রিজার্ভ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও হৃদয়বিদারক সমুদ্র দুর্ঘটনা টাইটানিক ডুবি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে...