সংবিধান সংস্কার ও সংসদ কাঠামোয় উচ্চকক্ষ যুক্ত করার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের আবহ তৈরি হয়েছে। এই প্রস্তাবে উচ্চকক্ষের সদস্যদের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন—পিআর) করার সুপারিশ থাকলেও তা মানতে রাজি নয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। দলটির মতে, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে এবং এই প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া হলে দলটি রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
বুধবার ও বৃহস্পতিবার টানা দুই দিনের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিএনপি মনে করে, বাংলাদেশে প্রাদেশিক বিভাজন না থাকায় উচ্চকক্ষ গঠনের যে যৌক্তিকতা উন্নত বিশ্বে রয়েছে, তা এখানে প্রযোজ্য নয়। তবু জাতির অভিজ্ঞ নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আইন প্রণয়নে জ্ঞানভিত্তিক অবদান রাখতে একটি উচ্চকক্ষ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেই কাঠামো যেন সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, গুণগত মান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গঠিত হয়—এটাই দলটির অবস্থান।
প্রসঙ্গত, বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের পঞ্চম দফাতেই উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রশাসক প্রমুখ বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি আইনসভার উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের পরিকল্পনা আছে দলটির। তবে বিএনপি মনে করে, পিআর পদ্ধতি অনুযায়ী দলভিত্তিক আসন বণ্টন করলে উচ্চকক্ষ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এবং সেই সম্ভাবনা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
উচ্চকক্ষ নিয়ে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে কমিশন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল সংসদে নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ এবং নারী সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রেও পিআর পদ্ধতির পক্ষপাতী হলেও বিএনপি স্পষ্টভাবে এর বিরোধিতা করেছে।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদের উচ্চকক্ষ রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার জ্ঞান-ভিত্তিক অবদান রাখার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এখানে ভোটের অনুপাতে আসন ভাগ হলে গুণমানের পরিবর্তে সংখ্যাই মুখ্য হয়ে উঠবে, যা এই স্তরের মূল উদ্দেশ্য নষ্ট করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে, সেই প্রেক্ষাপটে আরেকটি সংসদীয় কাঠামো তৈরি করা মানে রাষ্ট্রের ব্যয় ও প্রশাসনিক চাপ বাড়ানো। এই মুহূর্তে এই প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আরও যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নারী সংরক্ষিত আসনের পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো ইত্যাদি। যদিও এসব বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সভাপতিত্ব করেন। উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অন্যান্য নেতারা।
বিএনপি মনে করে, জাতীয় ঐকমত্যের নামে প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করতে পারে। উচ্চকক্ষ গঠন হোক আলোচনার ভিত্তিতে, সম্মতির ভিত্তিতে, এবং সর্বোপরি জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বার্থরক্ষার ভিত্তিতে—এটাই দলটির চাওয়া। অন্যথায় তারা রাজনৈতিকভাবে প্রতিবাদে নামবে বলেও দলের একাধিক নেতা স্পষ্ট করেছেন।
Leave a comment