রাজধানীর আদাবরে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সংঘটিত এক রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা জনমনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। নবোদয় হাউজিংয়ের বায়তুল মামুর জামে মসজিদের সামনে এক সালিস বৈঠকে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে একজন ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে অপর পক্ষের একজনকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন। হত্যাকাণ্ডের ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়, সাদা টি-শার্ট ও নেভি ব্লু জিন্স পরা এক যুবক কালো ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে মো. ইব্রাহিম শিকদার নামের এক ব্যক্তিকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ইব্রাহিম মাটিতে লুটিয়ে পড়লে, উপস্থিত জনতা হামলাকারীকে ধরে ফেলে এবং বেধড়ক মারধর করে।
পরে পুলিশ এসে গুলিবর্ষণকারী সজীব (৩২) এবং তার ভাই রুবেলকে (৩৫) উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। একইসঙ্গে তাঁদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। আদাবর থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা এবং অস্ত্র আইনে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নিহত ইব্রাহিম শিকদার (৩৮) পেশায় একজন গাড়িচালক ছিলেন এবং নবোদয় হাউজিং এলাকায় স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন আগে ইব্রাহিমের ভাগনে সুজন শিকদার আদাবরের কাঁচাবাজারে ডিম ব্যবসায়ী সজীবের দোকানে কাজ করতেন। ভ্যানে ডিম আনার সময় কিছু ডিম ভেঙে গেলে সজীব ক্ষিপ্ত হয়ে সুজনকে মারধর করেন। ওই ঘটনার জেরে গতকাল সন্ধ্যায় সালিস বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
সালিস চলাকালে সজীব উত্তেজিত হয়ে ইব্রাহিমের গালে চড় মারেন, যার পর দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে সজীব পিস্তল বের করে গুলি ছোড়েন, যা প্রথমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পরবর্তীতে বাইরে গিয়ে ফের গুলি করে ইব্রাহিমকে হত্যা করেন। এ সময় রাস্তায় উপস্থিত লোকজন সজীব ও রুবেলকে ধরে ফেলে এবং মারধর শুরু করে। পরে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠায়।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান জানান, অভিযুক্ত দুই ভাই বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন এবং সুস্থ হলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অস্ত্রের উৎস ও মালিকানা সম্পর্কে জানা হবে। তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায়। সজীব ঢাকার সাভারে এবং রুবেল আদাবরেই থাকতেন।
এদিকে নিহত ইব্রাহিমের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “বিনা দোষে আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। সে তো শুধুই সালিসে গিয়েছিল, অস্ত্র নিয়ে যায়নি। এখন আমাদের তিন বছরের সন্তান নিয়ে আমি কোথায় যাব?”
একইদিন সন্ধ্যায় আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে মোহাম্মদপুর এলাকায়। বাসা থেকে ডেকে নিয়ে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মো. আল আমিন (৩৮) নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কিশোর গ্যাং ‘এবি গ্রুপ’-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। পুলিশ সূত্র জানায়, আল আমিন সম্প্রতি এক ছিনতাইকারীর অবস্থান জানিয়ে তাকে ধরিয়ে দেন, যার প্রতিশোধ হিসেবেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।
তবে আল আমিনের ছোট ভাই দাবি করেন, তাঁর ভাই মূলত একজন সিএনজি চালক ছিলেন এবং গ্যাং-এ যোগ না দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা তাঁকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নিহত আল আমিনের বাড়ি শরীয়তপুরে, বাবা একজন গাড়িচালক।
রাজধানীর এই দুই হত্যাকাণ্ড শহরবাসীর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। প্রকাশ্যে পিস্তল ব্যবহার, সালিসে খুন, গ্যাং সংক্রান্ত প্রতিশোধমূলক হামলা—এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সক্রিয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
Leave a comment