ঢাকার লালবাগ ও চকবাজার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনভিত্তিক পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার নামে বিদেশি পরিচয়ে ভেজাল ও নকল প্রসাধনী বিক্রি করে আসছিল একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এসব পণ্য ছিল অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনক, কিন্তু বাহারি মোড়ক ও বিদেশি ব্র্যান্ডের ছাপা লোগো দিয়ে সরল ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হতো। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের পুরাতন ভাড়ালিয়ায় অভিযান চালিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই চক্রের অন্যতম এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মো. হৃদয় হোসেন, বয়স ২৫ বছর। তাঁর বাড়ি কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকায়।
সিআইডির একটি বিশেষ দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই অভিযান চালায়। সেখান থেকে নকল ও ভেজাল পণ্যের একটি গুদামঘর চিহ্নিত করা হয়, যেখানে নানা ধরনের তথাকথিত বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন, মোড়কজাতকরণ এবং সংরক্ষণ চলছিল। সিআইডির সদস্যরা সেখান থেকে মোট ৯ ধরনের ১ হাজার ৭০টি প্যাকেট এবং ২০০টি খালি মোড়ক জব্দ করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হৃদয় হোসেন জানিয়েছেন, এগুলো কোনো বিদেশি কোম্পানির পণ্য নয়, বরং দেশেই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে বিদেশি ব্র্যান্ডের অনুকরণে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কেম কট থাই, এল অ্যাভিনিউ হোয়াইটনিং বডি ক্রিম, অর্গানিক হেয়ারফর অয়েল, কেম বো হোয়াইটনিং বডি ক্রিম, অজুফি হোয়াইটনিং বডি ক্রিম, কোরিয়ান ফেয়ার লুক পারমান্যান্ট হোয়াইটনিং বডি লোশনসহ আরও কয়েকটি প্রসাধনী, যেগুলোর উৎপাদন ও বিপণনে কোনো লাইসেন্স বা বৈধতা ছিল না।
উদ্ধারকৃত পণ্যের মোড়কগুলো এতটাই পেশাদারভাবে ছাপানো ছিল যে, সাধারণ গ্রাহক বা খুচরা বিক্রেতা তা দেখে সহজে প্রতারণা বুঝতে পারত না। এই চক্রটি ‘লাগেজ পার্টি’র মাধ্যমে বিদেশি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করত। পরে সেই নমুনা থেকে স্থানীয় কারখানায় অনুরূপ পণ্য উৎপাদন করে মোড়কে বিদেশি নাম বসিয়ে বাজারজাত করত। মূলত তারা প্রসাধনীগুলো এমনভাবে প্যাক করত যাতে দেখতে অবিকল আসল বিদেশি পণ্যের মতো মনে হয়।
সিআইডির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ ধরনের পণ্য চক্রটি রাজধানীর লালবাগ, চকবাজার ও আশপাশের এলাকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিক্রি করত। এমনকি অনেক ব্যবসায়ী নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার ও চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব পণ্য ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতেন। পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন করলেই বলা হতো, ‘বিদেশি পণ্য, ছাড়ের জন্য দাম কম।’ এতে ক্রেতারা প্রতারিত হয়ে পণ্যের মান খারাপ হলেও অভিযোগের পথ খুঁজে পেতেন না।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, হৃদয় হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরেই এভাবে ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদন করে আসছিলেন। তাঁদের কোনো বৈধ ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই অনুমোদন বা প্রসাধনী উৎপাদনের মানদণ্ডে ছাড়পত্র নেই। এই কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এই ধরনের পণ্য মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জি ও ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় এমন উপাদান অনেক সময় এই ভেজাল প্রসাধনীতে থাকে। অথচ গ্রাহকরা মনে করেন, তারা কমদামে বিদেশি প্রসাধনী কিনছেন, যা তাঁদের সৌন্দর্য বাড়াবে। এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই চক্রটি ব্যবসা করে আসছিল।
সিআইডি জানায়, চক্রটির মূলহোতা ও অন্যান্য সদস্যদের শনাক্তে অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। যেসব পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এই চক্রের পণ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের পণ্য বিক্রি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ জনগণকে সতর্ক করে বলেছে, কোনো বিদেশি প্রসাধনী কেনার আগে অবশ্যই তা আসল কিনা যাচাই করা উচিত। অনুমোদিত দোকান ও নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অতি আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, অস্বাভাবিকভাবে কম দাম বা অজানা ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
সূত্র: সিআইডি, ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ।
Leave a comment